গোলাম মাওলা রনি: পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ? বঙ্কিমের নায়িকার এই উক্তি কতকাল কতবার যে ব্যবহৃত হয়েছে তা অবশ্য আমার জানা নেই। এতকাল পর সেই উক্তি বারবার মনে পড়ল অশান্ত বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতির ধরন-বরণ দেখে। দেশের বিবদমান দুটি রাজনৈতিক জোট তথা দল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে। একটি দল অপর একটি দলকে এমনভাবে আক্রমণ করছে যাতে স্পষ্টতই একজনের পতন প্রায় নিশ্চিত অথবা দুটি দলই হয়তো বা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এ অবস্থায় দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তো বটেই দল দুটির শান্তিকামী কর্মী-সমর্থকরাও পড়েছেন ভারি বিপদে। তারা না পারছেন তাদের দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করতে কিংবা দৈনন্দিন দুর্ভোগকে মেনে নিতে।
প্রথমে বলে নিই সরকারি দলের পথ হারানোর উপাখ্যান। পরে বলব বিরোধী দলের কাহিনি। সরকারি দল গত একটি বছর ধরে বিরোধী দলকে ঠাট্টা-মশকারা করতে করতে নিজেদের বোধ-বুদ্ধি এবং বিবেককে এমন একটি স্থানে নিয়ে এসেছেন, যেখান থেকে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা, কর্মকৌশল কিংবা কর্মপরিকল্পনা দেখা যায় না। সরকারি আসনগুলো থেকে বিরোধী দলকে তেলাপোকার মতো অসহায়, বাইল্যা মাছের মতো নরম এবং পোষা মিনি বিড়ালের মতো অনুগত মনে হতে লাগল। অহংবোধের আতিশয্যে সরকারের কয়েক মন্ত্রীর একজন হয়ে গেলেন মনোবিজ্ঞানী; আরেকজন হলেন রাজনীতির শিক্ষক এবং অন্যরা হয়ে গেলেন বিএনপির অভিভাবক ও উকিল। তারা বললেন আসো তোমাদের রাজনীতি শিখিয়ে দিই। তোমরা অবুঝ এবং বেকুবের দল। আন্দোলন কীভাবে করতে হয় তা আমাদের কাছ থেকে শিখে নাও। কয়েকজন বলল তোমরা তাড়াতাড়ি নাকে খত দাও এবং শেখ হাসিনার পা ধরে মাফ চাও।
অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, জনগণ সরকারি দলের প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করল এবং ভাবল, বিএনপির ন্যূনতম যোগ্যতা নেই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে এতটাই অপ্রতিরোধ্য মনে করতে থাকল যে, আগামী ৫০ বছর হয়তো দলটিকে ক্ষমতা থেকে কেউ সরাতে পারবে না এমনতর চিন্তা থেকে লোকজন দলটির প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভয় প্রদর্শন শুরু করল। এভাবেই চলছিল এই বছরের ৫ জানুয়ারির পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। সরকার হয়তো মানুষের মনের ভাব টের পেয়ে গিয়েছিল। আর তাই এমপি থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সবাই হুমকি-ধমকি দিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। প্রথমদিকে এসব হুমকি-ধমকি শুনলে বিরক্ত লাগত। পরে পরিস্থিতি এমন হলো যে, হুমকি ছাড়া জনগণের পেটের ভাত হজম হতো না। টিভি খুলে তারা বাহারি মন্ত্রীদের বাহারি কথা শুনতেন খাবার টেবিলে খাবার ঠিক আগে অথবা পরে। যেদিন পরিবারে পোলাও-মাংসজাতীয় খাবার রান্না হতো সেদিন প্রথমে পেট পুরে খেত তারপর টিভির সামনে বসত যাতে করে খাবারগুলো সহজে হজম হয়ে যায়। অন্যদিকে যেদিন রান্নাবান্না ভালো হতো না বেগুন, কলা, কচুর লতি ইত্যাদি রান্না হতো সেদিন বাড়ির লোকজন আগেভাগে টিভির সামনে বসে ক্ষমতাবানদের নাচন-কুদন এবং হুমকি-ধমকি শুনতেন। এতে করে তাদের ক্ষুধা বেড়ে যেত এবং খাদ্যের প্রতি রুচি চলে আসত।
বিরোধী দল ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুরে একটি সমাবেশ করতে চাইল। সরকারি দলের নেতারা ভাবলেন বিএনপি এখন এত ছোট দল যে, তাদের প্যাদানি দেওয়ার জন্য মূল সংগঠনের শীর্ষ কোনো নেতার দরকার হবে না। অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছাত্রলীগই যথেষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। বাস্তবে হলেও তাই। বড় নেতারা সব চুপ থাকলেন আর ছাত্রলীগের নেতারা সব এগিয়ে এলেন। আরও আশ্চর্য ঘটনা হলো ছাত্রলীগের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নন গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ বিএনপিকে হুমকি দিল গাজীপুরে বেগম জিয়ার কোনো সমাবেশ হবে না। প্রথমে দু-একদিন বিএনপি প্রাণপণ চেষ্টা করল গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কিছু একটা করে পুরো জাতিকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অজানা কারণে টঙ্গী-গাজীপুরের বিএনপি নেতাদের কী হলো তা কেবল আল্লাহই বলতে পারবেন। তারা সবাই ঢাকা এসে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আচ্ছামতো বোঝালেন। তারা আবার সদলবলে তাদের নেত্রীকে সজোরে বোঝাতে বাধ্য করলেন যে, এই মুহূর্তে গাজীপুরে ঝামেলা করে শক্তিক্ষয়ের দরকার নেই। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় মহাসমাবেশ করে সরকারের বারোটা বাজিয়ে দেব। বেগম জিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেতাদের চাপের মুখে তার গাজীপুর সফর বাতিল করেন।
অবশেষে ৫ জানুয়ারি এলো। সরকার বললÑ আমরা দিনটিকে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করব। কারণ এই দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে তাবৎ দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সুমহান এক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওইদিন যদি গণতন্ত্রের আওয়ামী ভার্সন উন্মোচিত না হতো তবে সোনার বাংলা জ্বলেপুড়ে অঙ্গার অর্থাৎ কয়লা হয়ে যেত। তাই কয়লামুক্ত দিবস হিসেবে ৫ জানুয়ারিকে স্বর্ণালিরূপে বরণ করে নেওয়ার জন্য সবাইকে প্রস্তুত হতে বলা হলো। ওইদিন সবাইকে সর্বশক্তি এবং সর্বসাধ্য নিয়ে রাস্তায় নেমে পাড়া-মহল্লা-অলিগলি, গ্রাম-গঞ্জ এবং হাটবাজারে ৫ জানুয়ারির সুমহান সফলতা প্রচার করতে বলা হলো। চারদিকে সাজসাজ রব পড়ে গেল জনগণ ধন্য ধন্য করতে লাগল।
৫ জানুয়ারিকে ঘিরে সরকারের সব শুভ পরিকল্পনায় বাদ সাধল বিএনপি। তারা গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বেয়াদবিটা করে বসল। বলল ৫ জানুয়ারিকে তারা গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করবে। সারা দেশ থেকে লোকজন এনে ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করে দেখিয়ে দেবে, বিএনপি কতটা শক্তিশালী। সরকার মনে মনে হাসল এবং ঠাট্টা করে বলল কিছুই করতে পারবা না ঘোড়ার ডিমও হবে না। আমরা ওইদিন উৎসবে মাতব আর তোমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবা। আর বাড়াবাড়ি করলে পিডাদিমু!
৫ জানুয়ারির ৩-৪ দিন আগে থেকেই সারা দেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও কর্মচারীরা বললেন আমরা বিএনপির লোকদের বাস, ট্রাক কিংবা লঞ্চে চড়াব না। তারা বিএনপিকে এতটাই ঘৃণা করতে শুরু করলেন যে, বাস, ট্রাক, টেম্পো, ভটভটি, ইজিবাইক এমনকি হোন্ডা চালানো বন্ধ করে দিলেন। ঢাকার আবাসিক হোটেলের মালিক-কর্মচারীরা বললেন নব্যগণতন্ত্রের সম্মানার্থে আমরা বিএনপির কোনো লোককে আমাদের হোটেলে থাকতে দিমু না। ভাত-মাছ বিক্রেতারা বললেন আমরা তাদের খাদ্য দিমু না। দোকানে খাবার খেতে এলে খুঁজে খুঁজে ওদের পরিচয় বের করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিমু কত্তবড় সাহস! গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে! আবার ভাত খাইতে চায়!
দেশের নবতর গণতন্ত্রের পূজারি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তৎপরতায় ঢাকা ফাঁকা হয়ে গেল। সারা দেশের গাড়ির ঢাকা। ঘোড়ার খুর আর লঞ্চ-রেলের হুইসেল বন্ধ হয়ে পড়ল। সরকার বিএনপি নেত্রীকে বালি থেরাপি দেওয়ার আয়োজন করল। কারণ ২০১৪ সালের বালি থেরাপি নাকি ভীষণ কাজ দিয়েছিল। সেই থেরাপির কারণে গত এক বছরে বিএনপি কোনো বিষ-বেদনা অনুভব করেনি। পুরোটা বছর ধরে তারা নবতর গণতন্ত্রের সেবা করেছে সরকারের মনোরঞ্জনে নানানতর বিনোদন করেছে। বছরের শেষদিকে যখন আবার বিএনপি মার্কা গণতন্ত্রের বেদনার চিৎকার শুরু হলো তখন সরকারি ডাক্তাররা বললেন ওরে বালি নিয়ে আয়! খোয়া নিয়ে আয়! তাড়াতাড়ি থেরাপি দেয় পারলে সঙ্গে একটু ঝালটাল রাখিস! ঘটনার দিন ৫ জানুয়ারি ২০১৫ সবকিছু ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা করল ঝালে। একে তো বালু থেরাপি তার ওপর মরিচের তেলের প্রয়োগ! বিএনপি নেত্রীর মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ডেকে বসলেন। সরকারি দলের নেতারা বেগম খালেদা জিয়ার ওপর বালু ও মরিচ থেরাপির কার্যকারিতা দেখে তারা আনন্দ পেলেন। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন অবরোধ না ঘোড়ার ডিম! কিছুই হবে না! এভাবেই দিন যেতে থাকল। সপ্তাহ চলে গেল। সরকার বুঝলÑ কিছু একটা হচ্ছে যা কি না আগের মতো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাদের চিরায়ত বাগম্বড় বন্ধ হয়ে গেল। অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল।
দেশীয় মিডিয়াগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে হরতাল-অবরোধের খবর প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে তা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। ফলে বিদেশের মাটিতে কর্মরত প্রায় দেড় কোটি বাঙালি প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং ভয়ে অস্থির হয়ে বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে বারবার ফোন করছেন। বিদেশি রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের উৎকণ্ঠা দেখাচ্ছে। কয়েকটি রাষ্ট্র ইতোমধ্যে তাদের নাগরিকদের এ দেশে চলাচলে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে। কয়েকটি দূতাবাস সরকারের কাছে বাড়তি নিরাপত্তা দাবি করেছে। বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী, ক্রেতা এবং সরকারি কর্তারা এদেশে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন উদ্ভূত সমস্যার কারণে।
দেশের প্রান্তিক চাষি, খুদে ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক-কর্মচারী-মালিক, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যাংকারসহ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই কপাল চাপড়াচ্ছেন এবং চিৎকার করে বলছেন এই কদিনের অবরোধে ৭০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হয়ে গেছে যা কোনোদিন পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চলছে না। কোনো পাবলিক পরীক্ষাও হচ্ছে না। সরকারি কর্তারা নিয়মিত অফিসে আসছেন না। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কান্ত হয়ে পড়েছে। চারদিকে কেবল হাহাকার আর হাহাকার। দিনের বেলায় ঢাকা শহরে কিছু গাড়ি চলে রাত হলে পুরো শহর ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। সারা দেশের মহাসড়কগুলোতে কোনো যানবাহন নেই। পুলিশ পাহারায় মাঝে মধ্যে কিছু ভারী পণ্যবাহী যান চলাচল করে এবং ২-৪ জন অতি সাহসী কিংবা অতি অভাবী মানুষ জানমালের ঝুঁকি নিয়ে বাস-গাড়ি চালায়। এ অবস্থায় বিরোধী দল আবার নতুন করে একের পর এক হরতাল ডেকে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক করে তুলছে।
দেশবাসীর যত দুর্ভোগ এবং যত কষ্টই হোক না কেন, সরকারি প্রচারমাধ্যমে বলছে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। আবার একটু পর বলছে সব গেছে, সব খেয়েছে, সব মেরেছে এবং সব করেছে ওই অবরোধের কারণে। এ অবস্থায় সরকারি ডাক্তাররা বলছেন চিন্তার কোনো কারণ নেইÑ আমরা রোগ ধরতে পেরেছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। উৎসাহীরা বললেনÑ কী রোগ ধরেছেন। তারা বললেনÑ বেগম জিয়ার রোগগুলো ধরতে পেরেছি। তিনি সারাদিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখেন, লোকজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারেক জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। আমরা যদি ওইসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিই তাহলেই কেল্লা ফতে! তিনি আত্মসমর্পণ করে বলবেনÑ ওগো দয়া করো! ফিরিয়ে দাও আমার বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট আর ডিশ কানেকশনÑ বিনিময়ে আমি তুলে নিচ্ছি অবরোধ। ডাক্তারদের কথা শুনে ভোঁতা বাঙালি বলল ধন্য! ধন্য! এবার কিছু একটা হবে বটে!